Saturday, August 24, 2013

গ, ল আর প

 টানা তিনদিন কখনো ঝিরঝির কখনো বা মুষলধারে। নাহ এবার সত্যি বিরক্ত হচ্ছিল রেশমি। এমনিতে অবশ্য বৃষ্টি তার বেশ প্রিয় . গাছের টবে সোঁদা মাটির গন্ধ শোঁকা কিংবা কালো হয়ে আসা আকাশ দেখে "ওগো সাঁওতালি ছেলে" গাইবার মত তারুণ্য সুলভ রোমান্টিসিজম ও যে কখনো এক্সপ্লোর করেনা এমনটা  নয়।উল্টে মুড ভালো থাকলে রাস্তার গর্তে জমা বৃষ্টির জলে জোরে পা ফেলা কিংবা  জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটু বৃষ্টি ছোঁয়ার মত সারল্যও তার আছে। কিন্তু টানা তিনদিন? এই জলকাদা ঠেঙিয়ে যখন কাল অফিস ছুটতে হবে তখন সব সারল্য রোমান্টিসিজম ঘরে রেখে  হবে।
খাট থেকে নেমে জানলার ধরে এসে দাঁড়ালো রেশমি। ৪ তলার ওপর থেকে এপার্টমেন্টের বাইরের রাস্তা, দোকানপাট কী  ছোটই না  দেখায়। সামনের ২তলা বাড়ির থেকে দুটো কম বয়সী মেয়ে বেরিয়ে গলিটার সেস মাথার দিকে  এগিয়ে গেল।তারপর মেঝেতে জল পরে থাকলে পিঁপড়ের দল যেমন একদম সামনেটায় গিয়ে ফিরে আসে ওপর থেকে ওদেরকে দেখেও তেমনটাই লাগলো রেশমির।
নাহ কাল সকালে অফিসের প্রেসেন্টেশানটা নিয়ে এবার একটু বসা যাক। সবটাই তৈরী তবু লাস্ট মোমেন্টের প্রিপারেশন ... এটা রেশমির বরাবরের অভ্যেস।
৮ টা বাজে ঘড়িতে। আপাতত মা র পিসিমনির সান্ধ্য-সিরিয়াল পর্ব শেষ . গতকালের মত আজকেও সন্ধে হতে না হতেই কাগজটা  নিয়ে বসে গেছে মা।এরপর শুরু  হবে ফোন করা আর কাগজে টিক মারা। মা বাবাকে অনেকবার জিগেস করেছে রেশমি, বিয়েটা এক্ষুনি না করলে নয়? ওদিক থেকে ধরা বাঁধা উত্তর, এরেঞ্জড ম্যারেজ অত সোজা নয় , দেখতে শুনতেই কত সময় লেগে যায় কত জনের। দেখাই যাক না, তারপর সত্যিই যদি কাউকে পছন্দ হয়ে যায়  তখন না হয় কথা এগিয়ে রাখা যাবে। বিয়ে যখন রেশমির ইচ্ছে তখনই না হয় হবে।
আগে আগে আপত্তিটা আরো জোরালো করত ও।আজকাল ভাবে এক্ষুনি নয় মানে ঠিক কবে? এই উত্তরটা কি ও নিজেও ঠিক মত জানে? ১বছর ২বছর?ও এখন ২৯,  কেরিয়ার মোটামুটি জমে গেছে। তাহলে? মাথা থেকে রাহুলের ভূতটা নামার পর? কিন্তু এইভাবে দিনে এতটা ইনভলভমেন্ট, এত ক্লোজ বন্ধুত্ব  থাকলে কি সেটা সম্ভব? আবার হুট করে কথাবার্তা কমিয়ে দেয়া, নাহ সেটাও সম্ভব না। নিজের বাইরেটাকে এই বলে বোঝায় রেশমি, যে না, আমাদের এই বন্ধুত্বটা অনেক আগে। এসব প্রেম ফেম মন কেমন, এসব বোকা বোকা ব্যাপারের জন্য  আট বছরের বন্ধুত্বটা কিছুতেই নষ্ট করবে না ও। কিন্তু মনের মধ্যে নিজের অজান্তেই বেশ জানে ও, আসলে অর অত ধক নেই। রাহুলকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে ইচ্ছেই করে না ওর।
রাহুল আর রেশমি ইউনিভার্সিটিতে একসাথে পড়ত। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, খুব গভীর বন্ধুত্ব। কত আড্ডা ইয়ার্কি মন খারাপ বলা। হঠাৎ যে কেন রেশমির মনে হলো ব্যাপারটা আর আগের মত নেই, সব বদলে যাচ্ছে, এখন ভাবলে কেমন বিচ্ছিরি লাগে ওর।
তখন কিন্তু দারুন লাগত, সুরুতে একদম চুপচাপ ছিল রেশমি। তারপর
হঠাৎই একদিন সৌগতদের বাড়ির ছাদে একটু আড়াল খুঁজে রাহুলকে সবটা বলা।রাহুল অবশ্য কোনোদিনই ভালোবন্ধুর লাইনটা ক্রস করেনি। শুরুতেই বলেছিল রেশমিকে, ও এইভাবে ভাবছে না কিন্তু।
শুরুতে মনখারাপ হয়েছিল।তারপর ভয়। সম্পর্কটা ঘেঁটে যাওয়ার। অনেকদিন অবধি এক্সপেক্টেশান  একটা কোথাও ছিলও। তারপর ধীরে ধীরে রাগ হত ছেলেটার ওপর। কেন সেটা ও নিজেও ঠিক মত জানে না। নাহ আজকাল আর এই রাগটা হয় না ওর। বরং নিজের ওপর কেমন একটা মায়া হয়, সাথে ক জানে কেমন একটা বিরক্তি সবকিছুতে।
দূর আর ভালোলাগছেনা এসব ভাবতে। ল্যাপটপটা খুলে বসলো রেশমি। অভ্যেসবশত ফেসবুকটাও খুলল। সুনেত্রার বিয়ের অ্যালবামটা সবার ওপরে নিউজফিডে। এই তো গত বছর ব্রেকআপ হল সুবীর আর  সুনেত্রার।মাস ৩-৪ খুব মনখারাপ। অনেক রাতে রেশমির কাছেও ফোনকলস এসেছে। কিন্তু বছর ঘোরার আগেই আবিরের সাথে প্রেম আর ক'মাসের মাথায় বিয়ে। লাকি মেয়ে। দুর আবার সেই ফ্রাস্টু চিন্তা ভাবনা। সত্যি ব্যাপারটা থেকে বেরোতে হবে। এই লাস্ট ৪-৫ মাসে অনেক ভেবেছে ও ....কেন ব্যাপারটা এগলোনা ওদের মধ্যে? এত ভালো সম্পর্ক, আন্ডারস্টেন্ডিং এত ভালো, তাহলে? জাস্ট সেই ম্যাজিকটা  নেই তাই?
এত ভেবে  নেই। কোথাও না কোথাও ও নিজেও জানে এইসব পাগলামি একদিন কেটে যাবে, সবটা অন্যরকম খুব সুন্দর হয়ে যাবে। বাবা মার দেখে দেয়া কোনো ছেলেকেই হয়ত খুব ভালো লেগে যাবে ওর। তারপর দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার।ও ঠিক জানে। তবু এইসময় ঠিক বিশ্বাস হয় না সেটা।
চ্যাটবক্সে রাহুলের নামের পাশে ফোনের চিহ্ন। দিঘা গেছে রাহুল অফিসের বন্ধুদের সাথে। চ্যাট উইন্ডোটা ওপেন করলো রেশমি। ৩দিন আগেকার একটা চ্যাট। রেশমির ঘ্যানঘ্যান আর খুব যত্ন করে ওকে বুঝিয়েছে রাহুল জ সবটা ঠিক হয়ে যাবে আর রেশমিও অন্যকোথাও অন্যকারুর সাথে ভালই থাকবে। এমন্কারুর সাথে যার মনে সেই ম্যাজিকটা হবে রেশমির জন্য। মাথার ভেতরটা কেমন ঝিলিক মেরে উঠলো রেশমির। একেই কি মাথায় রক্ত চড়া বলে?
পাশের ঘর থেকে মা ডাকছিল। রাতের খাবার দেয়া হয়েছে।
খেয়ে দেয়ে এসে আবার কাজ নিয়ে বসলো ও। একবার পুরোটা চোখ বুলিয়ে ফেলতে হবে।
কাজে আর আজকে সত্যি মন বসছেনা। অনেক তো হলো। নাহ এভাবে আর বন্ধুত্ব রাখাও সম্ভব না। এমনিতেও সেভাবে কথা হয়েনি লাস্ট কদিন। দুজনেরই ব্যস্ততায়। এবার ধীরে ধীরে বেরোতেই হবে এটার থেকে। ল্যাপটপটা বন্ধ করে শুতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল রেশমি। একি! এত রাতে রাহুলের ফোন?১২টা বাজে। উনি তো আবার আরলি টু বেড  এন্ড আরলি টু রাইস পাবলিক। রাহুলের ফোন ইগনোরই করবে ভেবেছিল ও। কিন্তু এতরাতে কেন হঠাৎ ফোন সেটাও জানা দরকার। ধরবে কি ধরবে না করতে করতেই কেটে গেল লাইনটা। সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটস আপ এ ভয়েস মেসেজ, " ঘুমিয়ে পরেছিস নাকি রে? হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে রেশু। চিরকাল এইভাবেই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে থাকিস।"
চ্যাট উইন্ডোটা চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে রেশমির। সত্যি ওসব প্রেম ফেম মার গুলি। এই বন্ধুত্বটা ছাড়া সিম্পলি চলবে না।