মেয়েটার গালের
ডান পাশে হাতের কালো ছাপটা দেখে প্রথমটায় গা শিউরে উঠেছিল শেফালির।
আজ দিন দশেক হলো
বিল্টুর দোকানের পাশের ফ্ল্যাটবাড়িটায় কাজ ধরেছে সে।এমনি তো ভালই মনে হচ্ছে। টোনাটুনির
ছোট্ট সংসার।একটা বছর দশেকের ছোট মেয়ে আছে। দাদা সকাল সকাল অফিস বেরিয়ে যায়। বৌদি তবে
বেশ গুনী মেয়ে। বাইরে চাকরি করেনা বটে, তবে সারাদিন কিছু না কিছু নিয়ে মেতে আছে। অকারণে
কাজের মেয়ের পেছনে পরে থাকার মত একদমই না।
আজকে সকালে হঠাৎ
শেফালিকে ডেকে বলল, আজ দুপুরে যদি পারে একবার যেন ওর সাথে পাশের পাড়ার বস্তিটায়ে যায়
শেফালী। তারপর বুঝিয়ে বলেছিল, বৌদির একটা
NGO না কী যেন একটা দল আছে।তারা গরিব দুখীদের পাশে দাঁড়ায় টাড়ায় । ওই বস্তিতে নাকি
একটা বউকে তার বর খুব পিটিয়েছে কাল রাতে। তাই তাকে দেখতে যাবে বৌদিরা। "কিন্তু
আমি সেখানে গিয়ে কী করব?" বৌদির কথায় অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছিল ও।ভদ্দর ঘরের মেয়েমানুষ
হঠাৎ বস্তিতে কেন যাবে বাবা!! তাও আবার ওকে সঙ্গে নিয়ে। "দেখ শেফালী, তোমার সংসারেও তো কত অভাব, তুমিও
বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারনি, তবু তো চার বাড়ি কাজ করে নিজের মত কিছু রোজগার করছ তুমি,
স্বাধীন মত ঘুরছ ফিরছ, ভালো আছ আরো পাঁচটা তোমার মত মেয়ের চেয়ে। ওই মেয়েটার বর রোজ
ওকে কত মারধর করে, টাকা পয়সাও কিছু হাতে দেয়
না, মেয়েটা তাই চুপচাপ মুখ বুজে সব সহ্য করে। খেযে় পরে বাঁচতে হবে তো। তোমাকে
দেখলে, এই যে তুমি রোজ এত কষ্ট করেও নিজে স্বাধীন মত কিছু একটা করছ, এটা দেখলে, শুনলে
ও মনে জোর পাবে।"
বৌদির কথা খুব
যে বুঝেছিল ও ঠিক তা নয়। তবু একটা কৌতুহল হযেছিল, আর কিছু না হোক বিকেলে জল তুলতে এসে
কলের আড্ডায় পল্টুর মা আর মুন্নিকে বেশ জমিয়ে
একটা গল্প বলা যাবে।
এখানে বৌদির মতই
আরো দুটো দিদিমনি এসছে। বৌদির কথা মত ওই মেয়েটাকে যা বলার বলল ও। এখন ওরা সবাইও অনেক
বোঝাচ্ছে। সবটা খুব মন দিয়ে শুনছে না ও। বাইরে বৃষ্টি। ফিরেই আবার কাজে যেতে হবে। সেইসবই
মাথায় ঘুরছে এখন। তবে, বৌদির বলা একটা কথা খুব মনে ধরেছে শেফালির। "স্বপ্না, এই
যে তোমার বর রাতবিরেতে ফিরে তোমার
ওপর অত্যাচার করছে, তারপর আবার মন ভালো হলে সোহাগও করছে। তুমি ভাবছ, বর, সে যা খুশি তাই করতে পারে। কিন্তু এটাকে কি আর বেঁচে থাকা বলে?
বাঁচতে গেলে একটা স্বাধীনতা তো লাগে। নিজের এই চৌহদ্দিটার বাইরে একবার বেরিয়ে দেখো,
কাকে বলে ভালো থাকা।" কেমন যেন ভোটের আগে লোকগুলো যেমন করে বাড়ি বাড়ি এসে দেখা
করে অনেক কথা বলে যায়, ঠিক তেমন লাগছিল। উফ!! আজকে কলের আড্ডাটা জমে যাবে।
আধঘন্টা পরেই
ফিরে এলো ওরা। দু'বাড়ি কাজ সেরে বৌদির বাড়ির কলিং বেলটা বাজাল ও। বসার ঘরে ঢুকেই কোকিলের
আওয়াজ। এই অসময় কোকিল! আহা কী সুন্দর গান গায় না ওরা? নিজের বাকি কাজ সেরে বারান্দাটা
পরিস্কার করতে এসেই চমকে গেল ও। বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে সুতো দিয়ে একটা কোকিল বাঁধা।
আর বৌদির মেয়ে তিন্নি ছুটে ছুটে সেটাকে ওড়াচ্ছে। কোকিলটা ভয়ের চোটে কিছুটা উড়ছে কিন্তু
সুতো ছিঁড়ে পালাতে পারছে না। "এটা কী গো বৌদি??" বেখেয়ালে চেঁচিয়ে ফেলল শেফালি। বৌদির মুখে একগাল হাসি, "দেখ না, তিন্নিটার মাথায় ক'দিন ধরে কী ঢুকেছে, ও নাকি কোকিল পুষবে। আজকালকার বাচ্চা
মাথায় একটা কথা ঢুকলেই, ব্যাস। তোমার দাদা তো বিল্টুকে বলে রেখেছিল, এই একটু আগে ছেলে
কোত্থেকে এটা ধরে এনে হাজির। একশটা টাকা নিয়ে গেল। খাঁচা তো কেনা নেই তাই এখন এখানেই বেঁধে রেখে গেল।"
পাখিটা তখন প্রাণ
বাঁচাতে পালাচ্ছে।আর বার বার সুতোয় আটকে ফিরে ফিরে আসছে। নাহ কোকিলের ডাকটা শুনতে আর
একদম ইচ্ছে করছিলনা শেফালির।